দর্শনাসহ আশপাশ এলাকায় মাদকের ভয়াবহতা কমেনি : আত্মসমর্পণের দোহাই দিয়ে চলছে রমরমা মাদককারবার

 

দর্শনা অফিস: দর্শনাসহ আশপাশ এলাকায় মাদককারবারী ও আসক্তের সংখ্যা কোনোভাবেই যেন কমছে না। কদিন কিছুটা ঝিমিয়ে থাকলেও ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মাদক কারবারীরা। যে কারণেই দিনদিন ব্যাপক হারে বাড়ছে মাদকাসক্ত ও কারবারীর সংখ্যা। এখনো দর্শনাসহ আশপাশ এলাকায় যেন হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মাদকদ্রব্য। কারো মধ্যে প্রতিরোধের ভাষা, হচ্ছে না প্রতিকার। আবারো মাদকাসক্তরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। রক্ষকই যেন ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। সুযোগ বুঝে সুবিধা নিয়ে পকেট ভারী করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফরের কতিপয় অসাধু সদস্য। এলাকার মাদক বিক্রেতা ও এ অপকর্মে সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের দাবি উঠেছে সর্বমহল থেকে। মাদকাসক্তি বাংলাদেশে অন্যতম একটি ভয়াবহ সমস্যার নাম। বিগত বছরগুলোতে মাদকের বিস্তার ও অপব্যবহার গোটা যুবসমাজের ওপর আঘাত করেছে যার ভয়াবহতার বর্ণনা দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদক নেশা একটি নাম, কোনো বস্তু বা দ্রব্যের শিরোনাম নয়। নেশাকে সংজ্ঞায়িত করতে হলে বলতে হয় এমন কিছু দ্রব্য, ওষুধ কিংবা উত্তেজক ওষুধ, উপাদান যা ব্যবহারে একধরনের মানসিক প্রশান্তি, কল্পনা ও বাস্তবের মাঝা-মাঝি বিচরণ, স্নায়ু বৈকল্যের কারণে দেহে তীব্র সুখানুভূতি, হেলুসিনেশন, মতিভ্রম হতে পারে যা খুব সাময়িক। মূলত এ ঘোর লাগাটা বেশিদিন থাকে না। মাদকের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান মানব দেহের ওপর স্থায়ী এবং ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। এক কথায় এক পর্যায়ে মানসিক রোগীতে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক ব্যক্তিটিকে আমরা মাদকাসক্ত বলে থাকি। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান মাদকাসক্তদের মানসিক রোগী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে অনেক আগেই। একজন নেশাসক্ত ব্যক্তি নেশার মাধ্যমে ক্ষণকালের জন্য ভিন্ন এক লৌকিকতায়, আলাদা প্রশান্তির জগতে প্রবেশ করে। হতাশা, ব্যর্থতা, দুঃখ, ক্ষোভ থেকে ক্ষণকালের জন্য মুক্তি কিংবা প্রশান্তি পাওয়া জন্য এ নেশায় আসক্ত হয়। পরে অবলম্বন হিসাবে নেশাকে দাড় করানোর প্রতিযোগিতা চলে নিজের মধ্যে। আবার শুধুমাত্র অ্যাডভেঞ্চারের আশায়, বন্ধু-বান্ধবের কু-প্ররোচনায় পড়ে অনেকে নেশা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠে এবং ধীরে ধীরে নেশার ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নেশা বা মাদকাসক্তি নামক দীর্ঘস্থায়ী, যন্ত্রণাকর এই অধ্যায় অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে ঠিক কবে গোটা জাতির মাঝে অঙ্কুরিত হয়েছে, তা নিয়ে হয়তো কারো কোন মাথা ব্যথা নেই, তারপরেও মাদকদ্রব্যের নগ্নতা ও ভয়াবহতার নীল দংশন যুব সমাজকে মহামারীর মত গ্রাস করেছে। মাদকের প্রতি ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছে নতুন প্রজন্ম, ঠিক যেন একটি বিভীষিকা, জীবনকে পলে পলে দগ্ধ করার জীবনের সমস্ত চেতনাকে লুপ্ত করার, নাগরিক জীবনের সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষাকে আতুর ঘরে গলা টিপে মেরে ফেলার অপপ্রয়াস বটে। মাদকের অপব্যবহার ও কুফল সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা, উদাসীনতা, সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যর্থতা কোন অংশে কম দায়ী নয়। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের ফলে সামাজিক ভাবে যেমন অস্থিরতা, অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে, ঠিক তেমনি মাদকাসক্তরা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যে কারণে ধ্বংশ হচ্ছে, ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতীয় তথা দেশ। মাদকাসক্তকারিদের প্রতি অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমশ ঘৃণায় রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মাদকাসক্তরা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে অন্ধকার গলিতে। সামাজিকভাবে সম্ভ্রম হারিয়ে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে গোটা সমাজ থেকে। বঞ্চিত হচ্ছে নাগরিক সু-অধিকার থেকে, অনেকের সুন্দর শিক্ষা জীবন হচ্ছে ধ্বংস। এজন্য কি মাদকাসক্তরা-ই এককভাবে দায়ী? মাদকাসক্তির কুফল এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শারীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতা হ্রাস, জটিলতা যেমন লিভারে প্রদাহ, হেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার, এইডস সংক্রমণ, যৌন অক্ষমতা, হৃদরোগ, ফুঁসফুঁসে টিউমার, ক্যান্সার, কিডনি বিকল, মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়া নিশ্চিত। এছাড়া শিক্ষা, চাকরি কিংবা যেকোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, অপরাধ প্রবণ হওয়া। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মাদকাসক্তিকে তার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। মাদকাসক্তির কারণে বাড়ছে দাম্পত্য কলহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটনা। মাদকের এ ধরনের কুফল জেনেও টনক নড়ছে না যেন কারো। অনেকে আড়ালে-অবডালে থেকে মাদকদ্রব্য কারবারীদের সহায়তা করে নিজের পকেট ভারী করছে। দর্শনাসহ আশপাশ এলাকায় মাদককারবারীর সংখ্যা যেমন গুনে শেষ করা মুশকিল, তেমনি মাদকাসক্তদের সংখ্যা যে কতো তার হিসেব করা দুরুহ ব্যাপার। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে মাদককারবারী ও আসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সে মর্মে গোটা জেলা মাদকাসক্ত ও কারবারীদের তালিকা তৈরি করে পুলিশ।

পুলিশের তালিকা অনুযায়ী চুয়াডাঙ্গা জেলায় মাদককারবারীর সংখ্যা ছিলো প্রায় ১২শ। এদের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আত্মসমর্পণ করেছিলো ৪৬৫ জন। পুলিশি গোপন খোঁজ খবরে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ৭শ জন মাদক কারবারী ছিলো আত্মসমর্পণের বাইরে। তাদের মধ্যে সক্রিয় ছিলো ৫০৪ জন। পুলিশের তৈরি তালিকার বাইরে অসংখ্য মাদককারবারী ও অসক্ত রয়েছে। এখনো চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের বহুল আলোচিত আকন্দবাড়িয়া, রাঙ্গিয়ারপোতা ও সিংনগরের এখনো বসছে ফেনসিডিল ও ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রির মোকাম। সেই সাথে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাদকপাচারের নিরাপদ রুট দর্শনা হল্টস্টেশন এখনো রয়েছে নিরাপদই। স্টেশন এলাকায় এখনো মাদককারবারীদের কাছ থেকে প্রশাসনের নামে বখরা আদায় করছে দালালচক্র। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ প্রশাসনের নামে দালালচক্র বখরা আদায় করে থাকলে ও চুয়াডাঙ্গা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফরের পক্ষ থেকে দৈনিক, সপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক হারে টোল আদায় করে থাকেন এএসআই আকবর আলী ও সিপাহী রশিদ। আকবর ও রশিদকে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়, রাঙ্গিয়ারপোতা, আকন্দবাড়িয়া, সিংনগরসহ দর্শনার মাদকের বিভিন্ন পয়েন্টে। এক প্রকার প্রকাশ্যে তারা মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে বকরা আদায় করে থাকে বলে রয়েছে অভিযোগ। পুলিশের আত্মসমর্পণের সুযোগ কাজে লাগিয়েছে মাদক কারবারীরা। মাদক কারবারীচক্রের হোতাদের মধ্যে কেউ আত্মসমর্পণ করেছে কি-না তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। চুনোপুটিরা আত্মসমর্পণ করলেও তিমিরে রয়েই গেছে হোতারা। বর্তমানে আত্মসমর্পণের দোহাই দিয়ে যেন মাজায় গামছা বেধে নিজেকে ধোয়া তুলশি পাতা সাজিয়ে শুরু করেছে মাদক কারবার। আগের তুলনায় কোনোভাবেই কমেনি মাদক কারবার।

এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা গেছে, মাদকের স্পটের মধ্যে অন্যতম চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের বহুল আলোচিত ফেনসিডিলের প্রকাশ্য খোলা বাজার নামে খ্যাত আকন্দবাড়িয়া, রাঙ্গিয়ারপোতা, সিংনগর, দর্শনা পৌর এলাকার দক্ষিণচাঁদপুর, ঈশ্বরচন্দ্রপুর, শ্যামপুর জয়নগর, শান্তিপাড়া, রামনগর, আজমপুর, মোহাম্মদপুর, আনোয়ারপুর, পরাণপুর, কেরুজ এলাকাসহ বেশ বিভিন্ন মহল্লায় মারণনেশা ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, ভারতীয় মদ, কেরুজ ফরেন লিকার ও বাংলা মদের মোকামে পরিণত হয়েছে। দর্শনা ও আশপাশ এলাকার মাদক কারবারীদের কাছ থেকে আকবর ও রশিদ প্রতি মাসে কমপক্ষে ৮-১০ লাখ টাকা বখরা আদায় করে থাকে বলেও উঠেছে অভিযোগ। কবে মাদককারবারী ও এ কারবারের সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হবে? এ দাবি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা-৬ বর্ডার গার্ডের পরিচালক লে. কর্নেল আমির মজিদ, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার নিজাম উদ্দিন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আসলাম হোসেন সহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সূদৃষ্টি কামনা করেছে ভুক্তভোগী ও সচেচতন মহল।