ঝিনাইদহ মুক্ত দিবস আজ

মুক্তিযুদ্ধে ঝিনাইদহের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ : সংগঠিত হয় বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধ

 

ঝিনাইদহ অফিস: অসহযোগ প্রস্তুতিপর্ব, প্রতিরোধ, গেরিলা আক্রমণ ও শেষে সম্মুখসমরে বিজয় অর্জন, ১৯৭১ সালের এ ৪টি পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধে ঝিনাইদহের ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। ঝিনাইদহের পতন ঘটাতে স্বশস্ত্র পাকবাহিনীকে যে পরিমাণ ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিলো অন্যান্য স্থানে ততো ক্ষতি স্বীকার করতে হয়নি বলে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। এখানে সম্মুখ সমরসহ বেশ কয়েকটি গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ১৯৭১ সালের আজকের দিন ঝিনাইদহ হয় মুক্ত।

পাকবাহিনীর কাছে ঝিনাইদহের পতন ঘটতে যেমন বিলম্ব হয়েছিলো তেমন ঝিনাইদহ পাকহানাদার মুক্ত হয়েছিলো অতিস্বত্তর। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঝিনাইদহ সফরের পরপরই এখানে শুরু হয় পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রস্তুতি। মধ্য ফেব্রুয়ারির এ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পথ বেয়েই ঝিনাইদহে প্রথম আসে অসহযোগ আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে যা রূপ নেয় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে ঝিনাইদহ পাকহানাদার কবলিত হয় এবং ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকহানাদারের হিংস্র থাবা থেকে মুক্ত করা হয় ঝিনাইদহকে।

পাকবাহিনীর সশস্ত্র তিন প্লাটুন সৈন্য কনভয় যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়েছিলো মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেদ করতে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই আর যশোর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতে পারেনি। তাই যশোর ক্যান্টনমেন্টে জিওসি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালিয়ে ছিলো ঝিনাইদহের সর্বাধিক। ফলে মহকুমা শহরের দোকানপাট ভস্মিভুত হয়েছিলো, ধুলিসাৎ হয়েছিলো বাড়িঘর। প্রধান সড়কের আশে পাশে গ্রামগঞ্জে আগুন জ্বালিয়েছিলো দাউ দাউ করে। সংগঠিত হয়েছিলো একাধিক যুদ্ধ ও ঘটনা।

স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনসহ ঝিনাইদহের মুক্তিকামী ছাত্রজনতা অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ সংগ্রামে সর্বস্তরের জনগণকে সংঘবদ্ধ ও সম্পৃক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১১ মার্চ থেকে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে মহকুমা সদরসহ ৬টি থানায় চলতে থাকে সার্বিক প্রস্তুতি। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণের খবরে ঝিনাইদহের নেতৃবৃন্দ মহাকুমা পুলিশ সুপার মাহাবুব উদ্দিনের সাথে বৈঠকে বসেন এবং থানার অস্ত্রগার খুলে দেয়া হয়। পুলিশ-আনসারসহ জনতার মাঝে ৪ শতাধিক রাইফেলস ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে ট্রেনিং করানো হয়। আহ্বান জানানো হয় সংগ্রামের।

এদিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সামরিক কনভয়ের অগ্রযাত্রা ঝিনাইদহের সন্নিকটবর্তী হলে এসডিপিও মাহাবুব উদ্দিন তার পুলিশ দল ও সহযোগীদের নিয়ে গোটা ঝিনাইদহের বিদ্যুত বন্ধ করে দেয় এবং তারা কৌশলগত আত্বগোপন করে। পাকসেনারা কারো হদিস না পেয়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়। প্রতিরোধ সংগ্রামে গর্তখুড়ে ফাঁদ তৈরি, মহাসড়কে গাছের গুঁড়ি, তেলের ড্রাম প্রভৃতি ফেলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। ২৮ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিষ্টার আহমেদুল ইসলাম ছদ্দবেশ নিয়ে ঝিনাইদহে রাত্রীযাপন করেন। পরদিন এসডিপিও মাহাবুব উদ্দিনের সহয়তায় মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন।

১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারী কামান ও মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে এক সশস্ত্র কনভয় ঝিনাইদহের বারোবাজার ও কালীগঞ্জ দখল করে মহকুমা শহরের দিকে এগিয়ে আসে। এখানে মুক্তিকামী জনতা পাকবাহিনীকে বাধা দেয়। বিষয়খালীর কাছে বেগবর্তী নদীর দক্ষিণ তীরে দুপুর ১টার দিকে উভয়পক্ষে সম্মুখযুদ্ধ হয়। এ সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন যশোর সেনানিবাস ফেরত ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানরা, আনসার বাহিনীর সদস্য এবং মুক্তিপাগল হাজার হাজার ছাত্রজনতা। এ যুদ্ধে নেতৃত্বে দেন এসডিপিও মাহাবুব উদ্দিন। অসীম সাহসের কাছে হানাদার বাহিনীর কামানের গোলা ব্যর্থ হয়ে যায়। তারা বাধ্য হয়ে ফিরে যায় ক্যান্টনমেন্টে। ঝিনাইদহে থাকে মুক্ত এলাকা। বিষয়খালী যুদ্ধে নিহত হন দুঃখু মাহামুদ, সদর উদ্দিন, আব্দুল কুদ্দুস, খলিলুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, নজির উদ্দিন, এনামুল ও কাজী বদিউল ইসলাম। ঝিনাইদহের অমিত তেজি দামাল তরুন দল বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধ বিজয়ের গৌরবে প্রথম মাইলফলক স্থাপন করে বিষয়খালী যুদ্ধে। এ যুদ্ধের কাহিনী প্রথম বিদেশি রেডিও বিবিসি, ফরাসি বার্তা সংস্থা, অস্ট্রেলিয়া রেডিও এবিসিসহ বিশ্বব্যাপি প্রচার মাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়।

মহেশপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আজ ৬ ডিসেম্বর মহেশপুর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে এ দিনে মুক্তি বাহিনীরা পাকহানাদার বাহিনীকে হঁটিয়ে মহেশপুরকে মুক্ত করেছিলেন। ওই দিন দত্তনগর পাকস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী পিছু হঁটে। মহেশপুর উপজেলা কমান্ডার নুরুল ইসলাম জানান, ওই দিন মহেশপুরে দত্তনগর, ঘুগরি, যাদবপুর নাটিমা, জাগুসায় ও পৌর এলাকায় তুমুল যুদ্ধ হয় এবং পাকহানাদার বাহিনীরা পিছু হটতে হটতে কোটচাঁদপুর হয়ে ঝিনাইদহের দিকে চলে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধা বিজয় উল্লাস করে স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিবাহিনী। যুদ্ধে মেজর মুঞ্জুর নেতৃত্বে বীর মাহতাব, এফআর চৌধুরী, আবু তালেবসহ অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারা  অংশ নেয়।