ঝিনাইদহের তিনটি আসনে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ নেই ভোটারদের মাঝে

ঝিনাইদহ অফিস: ঝিনাইদহের চারটি আসনের তিনটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে মূলত আওয়ামী লীগেরই লড়াই হবে। প্রার্থীরা কম-বেশি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগপত্র জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতরে জমা পড়েছে। বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের হরতাল অবরোধ সত্বেও প্রার্থীরা নির্বাচনী এলাকায় দিন-রাত প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। চলছে মিছিল-মিটিং সমাবেশ। তবে ভোটের মাত্র ১৩ দিন বাকি থাকলেও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

জেলার চারটি আসনের তিনটি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্রপ্রার্থী। আর একটি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সাথে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। স্থানীয় নির্বাচন অফিস থেকে জানা যায়, ঝিনাইদহ জেলার চারটি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বিভিন্ন দল থেকে ১৮ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বাছাইয়ের সময় তিনজনের মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। সর্বশেষ চারজন প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেয়ায় বর্তমানে প্রার্থীর সংখ্যা ১১ জন।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চারটি আসনের সব প্রার্থীই কম-বেশি গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন। তবে চোখে পড়ার মতো প্রচারণা এখনো শুরু হয়নি। নির্বাচনী পোস্টার, মিছিল-সমাবেশ, মাইকে প্রচার বা নির্বাচনী কার্যালয় খুলে চা-পান করানোর মতো দৃশ্য চোখে পড়ছে খুব কম। সদর উপজেলার হাটগোপালপুর এলাকার একজন ভ্যানচালক বলেন, ‘ভোট দিলিও কী আর না দিলিও কী। এক দলেরই তো দুজন। ভোট না দিলিও তারা পাস করে যাবে।’ শৈলকুপার একজন স্কুলশিক্ষক বলেন, ‘এ তো আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগ খেলা ছাড়া আর কিছুই না। এ সহিংসতার মধ্যে ভোট দিতে গিয়ে জীবন ঝুঁকিতে ফেলার তো কোনো মানে নেই।’

ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) আসনে তিনজন প্রার্থী থাকলেও সরাসরি লড়াই হবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই ও দলের বিদ্রোহী স্বতন্ত্রপ্রার্থী উপজেলা চেয়ারম্যান নায়েব আলী জোয়ারদারের মধ্যে। আবদুল হাই নৌকা ও নায়েব আলী জোয়ারদার ফুটবল প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে লড়ছেন। স্থানীয়দের থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের এ দু নেতা জনপ্রিয়তার দিক থেকে কেউ কারো চেয়ে কম নন। এ আসনে জেপি মঞ্জু সমর্থিত প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফাও প্রচার-প্রচারণ শুরু করেছেন। এদিকে আওয়ামী লীগের দু প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন। পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন দু প্রার্থী। স্বতন্ত্রপ্রার্থী নায়েব আলী জোয়ারদার অভিযোগ করেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবদুল হাই সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করছেন। প্রভাব খাটিয়ে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে আমার কর্মী সমর্থকদের ধড়-পাকড় ও হয়রানি করছেন। তার নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরসহ প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেয়া ও কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ করেন তিনি। সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে থানার ওসি আনোয়ার হোসেনের প্রত্যাহার ও সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন স্বতন্ত্রপ্রার্থী নায়েব আলী জোয়ারদার।

অন্যদিকে নায়েব জোয়ারদারের অভিযোগ প্রত্যাখান করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবদুল হাই অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করে স্বতন্ত্রপ্রার্থী নায়েব আলী উপজেলা চেয়ারম্যানের গাড়ি নির্বাচনী কাজে ব্যবহার করছেন। তার কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলাসহ সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই মিথ্যাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ঝিনাইদহ-২ (সদর ও হরিণাকুণ্ডু) আসনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সফিকুল ইসলাম অপুর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে তাহজীব আলম সিদ্দিকী সমি। স্বতন্ত্রপ্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগে অনেক সিনিয়র নেতা গণসংযোগ করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে স্বতন্ত্রপ্রার্থী সমি সিদ্দিকী ভোট চাইছেন আনারস মার্কায়। তবে বসে নেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী সফিকুল ইসলাম অপু। প্রতিদিনই তার পক্ষে মিছিল-মিটিং চলছে। এ আসনে বিএনএফ সমর্থিত প্রার্থী মমিনুল ইসলামের কোনো কর্মকাণ্ড এখনও চোখে পড়েনি।

ঝিনাইদহ-৩ (কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নবী নেওয়াজের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্রপ্রার্থী শফিকুল আজম খান চঞ্চল। তবে স্বতন্ত্রপ্রার্থীর প্রচার-প্রচারণা চোখে পড়ছে না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানিয়েছে, টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় বতর্মান সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান চঞ্চল দলের মনোনয়ন পাননি। আর দলীয় নেতাকর্মীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ। ফলে আওয়ামী লীগের সুবিধাবঞ্চিত ও ত্যাগী নেতারা দল সমর্থিত প্রার্থী নবী নেওয়াজের পক্ষে গণসংযোগ করছেন। এদিকে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় শফিকুল আজম খান চঞ্চলকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নবী নেওয়াজ প্রতিদিনই মহেশপুর-কোটচাঁদপুরের বিভিন্ন এলাকায় মিছিল-সমাবেশ করছেন। যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও নবী নেওয়াজের সমর্থকরা মনে করেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কোটচাঁদপুর ও মহেশপুরের মানুষ। ভোটকেন্দ্রে বিপুল সংখ্যক ভোটারকে হাজির করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তার কর্মী-সমর্থকরা। জাতীয় পার্টি-এরশাদ সমর্থিত প্রার্থী কামরুজ্জামান স্বাধীন এখনও প্রচার-প্রচারণা শুরু করেননি। এমন অবস্থায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নবী নেওয়াজ।

ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ ও সদরের একাংশ) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুল আজিম আনারের বিরুদ্ধে দলের বিদ্রোহী কোনো প্রার্থী নেই। এ আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির মোস্তফা আলমগীর। দু প্রার্থীই প্রতিদিন ছুটে চলেছেন গ্রাম-গঞ্জে। করছেন গণসংযোগ। তবে শক্ত কোনো প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নিজের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।

জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য ইলেকট্রনিক্যাল ইনকোয়ারি কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।