জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষনে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান:সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় আসুন

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনের সময় সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দিয়ে বিরোধীদলের সদস্যদের নাম চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে শুক্রবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, আমরা সকল দলকে সাথে নিয়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চাই। সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিরোধীদের কাছে পরামর্শও চেয়েছেন তিনি। তবে যে কোনো ধরনের অসাংবিধানিক সরকারের শাসনের বিরুদ্ধে নিজের দৃঢ় অবস্থানের কথা জাতির সামনে তুলে ধরে কার্যত বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি আবারো খারিজ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। হানাহানি ও সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে বিরোধীদলকে সংসদে আসার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন,  আলোচনার দরজা সব সময় খোলা। সংবিধান থেকে উদ্ধৃত করে  নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে নিজের অবস্থানের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি।
                প্রধানমন্ত্রীর ২০ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের এ বক্তৃতায় সরকারের গত পাঁচ বছরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও সাফল্যের কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও। তিনি বলেন, তার সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কঠোর হাতে জঙ্গিবাদ দমন করেছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণ সম্প্রচার করা হয়।

ইতিবাচক সাড়া চাই: প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের শুরুতেই জাতির উদ্দেশ্যে ঈদ, পূজা ও প্রবরণা পূর্ণিমার ‍শুভেচ্ছা জানান। ভাষণের প্রথম অংশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে সাফল্যের চিত্র তুলে ধরেন।  ভাষণের শেষ অংশে তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে নিজের প্রস্তাব তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা বলেন,  বিরোধীদলের কাছে আমার প্রস্তাব, নির্বাচনকালীন সময়ে আমরা সকল দলের সমন্বয়ে সরকার গঠন করতে পারি। আমাদের লক্ষ্য অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। এ জন্য বিরোধী দলের সদস্যদের নাম চেয়ে তিনি বলেন, তাই আমি বিরোধী দলের কাছে প্রস্তাব করছি যে, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেও আপনারা নাম দিতে পারেন যাদেরকে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মন্ত্রিসভায় সদস্য করে সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে পারি। শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন, এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে সবার সব সন্দেহ দূর করা সম্ভব হবে এবং জনগণ ভোট দিয়ে তাদের মনমতো সরকার গঠন করতে পারবে।

বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া এ প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেবেন বলেও আশাপ্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমি বিরোধীদলের নেতাকে অনুরোধ করছি যে, তিনি আমার এই ডাকে সাড়া দিবেন। আমার এ অনুরোধ তিনি রক্ষা করবেন এবং আমাদের যে সদিচ্ছা সেই সদিচ্ছার মূল্য তিনি দিবেন।

যথাসময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যাব: সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এই সময়ে সরকারে থাকবে আওয়ামী লীগ, সংসদও বহাল থাকবে, যা নিয়ে বিএনপি ও শরিকদের আপত্তি। নির্বাচনের আগে কবে সংসদ ভেঙে দেয়া হবে এবং সংসদের অধিবেশন কবে শেষ হবে তা নিয়েও দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অবস্থান বিপরীতমুখি। প্রধানমন্ত্রী আগেই জানিয়েছেন, আগামী ২৪ অক্টোবরের পর নবম সংসদের চলতি অধিবেশন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই; নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সংসদ চলতেই পারে। অন্যদিকে নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি নেতারা ২৪ অক্টোবরের পর দেশ অচল করে দেয়ার হুমকি দিয়ে আসছেন। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাচন কবে হবে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে লিখিত পরামর্শ দেবেন। সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে এবং নির্বাচন হবে।

এ প্রসঙ্গে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নব্বই দিনের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয়, সেজন্য মহাজোটসহ সবার সাথে পরামর্শ করে তিনি যথাসময়ে রাষ্ট্রপতিকে লিখিত পরামর্শ দেবেন। এক্ষেত্রে আমি বিরোধী দলের কাছেও পরামর্শ আশা করি।

সংবিধানের ৭২(১) ও ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন,  ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে। ২৫ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের প্রথম বৈঠক হয়। সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর থেকে নব্বই দিনের হিসাব শুরু হবে।

ধ্বংসের পথ ছাড়ুন: মানুষের কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও উন্নত জীবনই একমাত্র কাম্য জানিয়ে সংঘাতের পথ পরিহার করে সমঝোতার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণের পথে আসতে বিরোধীদলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিগত চার দলীয় জোট সরকারকে হত্যা-সন্ত্রাস-ধর্ষণ-লুটপাট-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন এবং ১/১১ নামের যন্ত্রণাময় অধ্যায়ের জন্যও বিএনপিকে দায়ী করেন। গত পাঁচ বছরে হরতালে সহিংসতা এবং জামায়াত-হেফাজতি তাণ্ডবের ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বোমা মেরে, আগুন জ্বালিয়ে জনগণের জানমালের ক্ষতি করবেন না। কোরআন শরিফ পুড়িয়ে, মসজিদে আগুন দিয়ে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা বন্ধ করুন। মাদরাসায় বোমা তৈরির কাজে ব্যবহার করতে এতিম বাচ্চাদের লাশ বানানো বন্ধ করুন। শেখ হাসিনা বলেন, ইসলাম কখনোই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অনুমোদন দেয় না। যারা নির্দোষ মানুষকে ধর্মের নামে হত্যা করে তাদের চূড়ান্ত ঠিকানা হবে দোযখ। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে ২৫ অক্টোবর রাজধানীতে জনসভার জন্য বিএনপি কর্মীদের দা, কুড়াল নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশও প্রত্যাহারের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ছুরি, দা, খুন্তা, কুড়াল নিয়ে মানুষ মারার নির্দেশ প্রত্যাহার করার জন্য আমি বিরোধীদলীয় নেতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

বিরোধীদলীয় নেতাকে সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে জনগণের ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা কী চান তা সংসদে এসে বলুন। আলোচনা করুন। আলোচনার দরজা সবসময় আমাদের পক্ষ থেকে উন্মুক্ত আছে। গত মে মাসে নিজের সংবাদ সম্মেলনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমি সংলাপে ডেকেছিলাম। দুঃখের বিষয় তার জবাবে তিনি আলটিমেটাম দিয়ে বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে ক্ষমতাচ্যুত ও দেশছাড়া করবেন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে জাতীয় সংসদে বিএনপির মুলতবি প্রস্তাব দেয়া এবং তা প্রত্যাহার করার বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনে আবারো মুলতবি প্রস্তাব দিন। জাতীয় সংসদে এবং সুস্পষ্টভাবে বলুন আপনারা কী চান?

অসাংবিধানিক শাসন আর নয়: বিএনপির তত্ত্বাবধায়কের দাবি কার্যত খারিজ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ২০০৭ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের কথাও মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ১/১১’র মতো কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের বুকের ওপর চেপে বসে তখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক-ছাত্র-পেশাজীবী, ব্যবসায়ীসহ সবার ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। এ ধরনের অসাংবিধানিক শাসনের পুনরাবৃত্তি আর কখনোই হবে না- এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াও যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তার নজির হিসাবে বর্তমান সরকারের সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে পাঁচ হাজার ৭৭৭টি নির্বাচনের কথা বেলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, কোনো নির্বাচনেই সরকার হস্তক্ষেপ করে নেই। অনেক নির্বাচনে বিরোধীদলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে ইনশাল্লাহ। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বিরোধী দলীয় নেতাকে উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসুন, দেশ ও জাতির কল্যাণের স্বার্থে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরো সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করি। যাতে আমাদের তরুণ প্রজন্ম একটি সুন্দর সমাজ পায়। একটি সুন্দর সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ আমরা সকলে মিলে গড়ে তুলতে পারি।