‘আধুনিক দাসত্ব’ নিয়ে ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন ভারতের অবস্থান প্রথম, বাংলাদেশ দশম

মাথাভাঙ্গা অনলাইন : নতুন এক সমীক্ষায় বলা হচ্ছে আধুনিক বিশ্বে প্রায় তিন কোটি মানুষ দাসত্বের জীবন কাটাচ্ছেন। আর এর মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষই ভারতে দাসত্বের শিকার।

দাসত্ব-বিরোধী প্রচারণায় কাজ করছে অস্ট্রেলিয়ার এরকম একটি সংস্থা ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন তাদের বিশ্ব দাসত্ব সূচক ২০১৩ নামে তাদের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য দিয়েছে।
সংস্থার প্রধান নির্বাহী নিক গ্রোনো বলছেন, সমস্যা মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী নয়। তিনি বলেন, কোন দেশে মানুষ কী ধরনের দাসত্বের জীবন কাটাচ্ছে এবং সেসব দেশের সরকার সমস্যা সমাধানে কী করছে সেটা তারা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
নিক গ্রোনো “অনেক দেশের সরকারের জন্যই এ সমীক্ষার ফলাফল অস্বস্তির কারণ হবে। কিন্তু আমরা চাই সরকারগুলো বিষয়টা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করুক এবং সমস্যা মোকাবেলায় উদ্যোগী হোক।”
১৬২ টি দেশের তথ্য নিয়ে তৈরি এই সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতেই সবথেকে বেশি মানুষ দাসত্বের জীবন কাটান – সংখ্যাটা প্রায় দেড় কোটি। তারপরেই রয়েছে চীন আর পাকিস্তানের নাম।
বাংলাদেশ রয়েছে তালিকার দশ নম্বরে। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ দাসপ্রথার শিকার।
তবে জনসংখ্যার অনুপাতে দাসত্বের জীবন কাটান এমন মানুষের তালিকায় শীর্ষে মরিতানিয়া। সেখানকার জনসংখ্যার প্রায় ৪ % মানুষই দাসপ্রথার শিকার।
সমীক্ষাটিতে বলা হচ্ছে, ঋণের দায় মেটানোর জন্য যেমন বিনা-পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়, তেমনই রয়েছেন জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়া বা মানব-পাচারেরও শিকার হওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষ।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের এই নতুন ধরণের দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছে বন্ধুয়া মুক্তি মোর্চা। সংগঠনের প্রধান স্বামী অগ্নিবেশ বলছিলেন, এই সমীক্ষার ফলাফল মোটেই আশ্চর্যজনক নয়।
স্বামী অগ্নিবেশের কথায়, “৭৮-৭৯ সালেই গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন আর ভারতীয় শ্রম ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যে ভারতের দশটি রাজ্যে প্রায় ২৬ লক্ষ মানুষ দাসত্ব করতে বাধ্য হচ্ছেন।” নব্য দাসত্বের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের একটি উদ্যোগের তিনি প্রধান ছিলেন প্রায় দশ বছর।
স্বামী অগ্নিবেশ বলেন, “তখনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যে তথ্য আসত, তা থেকেও প্রমাণ পাওয়া যেত যে ভারতেই সবথেকে বেশি মানুষ নতুন ধরনের এই দাসপ্রথার শিকার হচ্ছেন।”
নতুন ধরনের এই দাসপ্রথার শিকার হওয়া মানুষদের একটা বড় অংশ শিশু।
বিবিসি-র মিডিয়া অ্যাকশন উদ্ধার হওয়া এরকমই কয়েকজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে, যারা খুব ছোট বয়সেই দাসত্বের জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এরকমই একজনের কথায়, “আমার যখন ৫ বছর বয়স, তখন থেকেই খেলার সময়ে জমিদারের লোকেরা আমাকে নিয়ে গিয়ে খাটাত, মারধর করত। তারপরে যখন বাবা মারা গেলেন, তখন জমিদারের লোকেরা একদিন খেলার সময়ে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। বললো, বাবার নাকি অনেক ধার-কর্জ রয়ে গেছে – সেগুলো শোধ করার জন্য আমাকে খাটতে হবে। ইঁটভাটায় নিয়ে গিয়ে মারধর শুরু হলো আর সেখানেই কাজ করতে বাধ্য করা হলো।”
গঙ্গোত্রী নামের একটি মেয়েকে তার আত্মীয়ই বাড়ির কাজের জন্য তুলে দেয় একটি পরিবারের হাতে। অকথ্য অত্যাচার সহ্য করার পরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পুলিশের সাহায্যে উদ্ধার করে মেয়েটিকে – উঁচু বাড়ির বারান্দায় মই দিয়ে উঠতে হয়েছিল পুলিশকে।
বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনকে গঙ্গোত্রী তার কাহিনী শুনিয়েছেন। “যাদের বাড়িতে আমাকে কাজ করার জন্য দিয়ে এসেছিল কাকা, সেখানে সবসময়ে কাজ করানো হত। খেতে দিত না আর মারধর তো ছিলই। একদিন তো আমার একগোছা চুলই টেনে তুলে দিয়েছিল। ওই বাড়িরই অন্য এক কাজের মহিলাকে আমি অত্যাচারের কথাগুলো জানাতাম।”
তার মাধ্যমেই একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তার দুর্দশার কথা জানতে পারে। বাড়ীর মালিকরা বাইরে গিয়েছিল – এরকমই এক সময়ে পুলিশকে নিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করা হয়। এখন ক্লাস সেভেনে পড়েন গঙ্গোত্রী।  পড়াশুনোর মধ্যে দিয়েই অত্যাচারের ওই দিনগুলো ভুলে থাকতে চান তিনি। গঙ্গোত্রীর স্বপ্ন শিক্ষিকা হওয়ার।
ক্রীতদাস প্রথা আইনত বিলুপ্ত হওয়ার এত বছর পরেও কেন ভারতে দাসত্বের জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন দেড় কোটি মানুষ?
স্বামী অগ্নিবেশের ব্যাখ্যা, “ভারতে যে বর্ণবৈষম্য রয়েছে, তথাকথিত নিচু জাতের মানুষের ওপরে যে শোষণ চলে, সেটাই দাসত্বের মূল কারণ। প্রথমে আদিবাসী বা পিছিয়ে থাকা মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় যে জল, জমি, জঙ্গল – সেগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তারপরে বাধ্য করা হয় শ্রমদান করাতে।”
তিনি বলেন, “অন্য প্রদেশে পাঠিয়ে দিয়ে শ্রমদানে বাধ্য করানো হয়, আবার চাষের ক্ষেতে, পাথর খাদানে, ইঁট ভাটায়, নির্মাণ শিল্পে বা রত্ন পালিশ করার শিল্পেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে এভাবে দাসত্বে জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়। বলতে গেলে অ-কৃষিজ সব ধরনের কাজই নতুন ধরণের এই দাসপ্রথা চলে।”
কয়েক দশক ধরে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে স্বামী অগ্নিবেশের মনে হয়েছে স্বাধীনতার দশ বছরের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় নি – সেটা আংশিকভাবে করা হলো ২০১০ সালে। এতগুলো বছরে তাই কোটি কোটি শিশু দাসত্বে জীবনে কাটাতে বাধ্য হয়েছে – সেই জীবনের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছেন ।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সমীক্ষাটির পেছনে প্রাক্তন মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট হিলারি ক্লিনটন আর প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী টোনি ব্লেয়ারের সমর্থন রয়েছে।
মিসেস ক্লিনটন সংবাদ সংস্থা এপি-কে জানিয়েছেন যে এই সমীক্ষাটি নির্ভুল নয়, কিন্তু দাসপ্রথার মতো একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করার জন্য এটার প্রয়োজন ছিল। সূত্র: বিবিসি।